Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা ও খাদ্য নিরাপত্তা

জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা ও খাদ্য নিরাপত্তা
ড. রিপন সিকদার
খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন একুশ শতকের সবচেয়ে বড় দুইটি চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা ৯ বিলিয়নে পৌঁছাবে এবং খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা ৮৫% বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে খরা, ভারী বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার তারতম্য, লবণাক্ততা এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণের কারণে কৃষি খাত হুমকির সম্মুখীন। প্রতি ডিগ্রি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বজুড়ে প্রধান খাদ্যশস্য যেমন- গম, চাল, ভুট্টা এবং সয়াবিনের উৎপাদন যথাক্রমে ৬.০% ৩.২%, ৭.৪% এবং ৩.১% হ্রাসের পূর্বাভাসও রয়েছে।
বৈষ্ণিক উষ্ণতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লবণাক্ততাজনিত সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে এই সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও লবণাক্ততা একটি প্রধান প্রাকৃতিক সমস্যা যা ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই ২০১২) এর তথ্য মতে, উপকূলীয় অঞ্চলের ২.৮৬০ মিলিয়ন হেক্টরের মধ্যে প্রায় ১.০৫৬ মিলিয়ন হেক্টর আবাদযোগ্য জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয়          কৃষি জমিতে মৃত্তিকা লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচ্য। উল্লেখ্য, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিগত ২৫ বছরে লবণাক্ততা ১ থেকে ৩৩% বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের ফলে খরা এবং বৃষ্টিপাতের মাত্রা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গড় মানের উপরে অবস্থান করছে। অগভীর পানির স্তর এবং সমুদ্রের পানির অনুপ্রবেশসহ উপকূলীয় অঞ্চলে পানির ঊর্ধ্বমুখী গতির ফলে উদ্ভিদের মূলাঞ্চলে লবণাক্ততা দেখা দেয়। মূলত বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন মৃত্তিকা লবণাক্ততার উপর বেশি প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শুষ্ক কৃষি জমিতে মৃত্তিকা লবণাক্ততা বৃদ্ধির জন্য বর্ধিত তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাত হ্রাসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব একে অপরের সাথে ধনাত্মকভাবে বা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
লবণাক্ততা একটি পরিবেশগত সমস্যা। যা কৃষি উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহত করে। বিশ্বব্যাপী ৮৩১ মিলিয়ন হেক্টরেরও বেশি কৃষি জমি লবণাক্ততা (লবণাক্ত প্রভাবিত এলাকা ৩৯৭ মি. হে ও সোডিসিটি বা ক্ষারীয় প্রভাবিত এলাকা ৪৩৪ মি. হে) দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত (সূত্র : খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ২০১৭)। লবণাক্ত পানি দিয়ে সেচ, কম বৃষ্টিপাত এবং উচ্চ বাষ্পীভবনের কারণে কৃষি জমিতে বার্ষিক ১০% হারে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হারে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০% এর বেশি আবাদি জমি লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লবণাক্ত জমিতে আবাদ সম্প্রসারণ বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১-২% জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হচ্ছে। চাষকৃত এলাকার প্রায় ৬% ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যার ফলে ধান, গম ও ভুট্টার মতো প্রধান দানাশস্যের ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চমাত্রার বাষ্পীভবনের কারণে মৃত্তিকা পৃষ্ঠের উপরের স্তরে লবণ জমা হয়। এই ধরনের লবণাক্ততার কারণে ভূগর্ভস্থ পানি লোনা হয়ে যায়। উচ্চ পরিমাণে দ্রবণীয় লবণের  সোডিয়াম ও ক্লোরিন আয়ন থাকে যা উপকারী পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং নাইট্রেট আয়নের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এই ক্ষতিকর সোডিয়াম ও ক্লোরিন আয়নের উপস্থিতি উচ্চমাত্রার আয়নিক লবণাক্ততা তৈরি করে, যা রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন সৃষ্টি করতে সহায়তা করে এবং ফসলের ফলনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
বীজের অংকুরোদগম থেকে শুরু করে চারা বড় হওয়া পর্যন্ত জমিতে লবণাক্ততা হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি/কৌশল অবলম্বন করা হয়ে থাকে যেমন- মৃত্তিকার ওপরের স্তর আঁচড়ানো, মৃত্তিকার উপরের স্তর অপসারণ, মানসম্পন্ন পানি দিয়ে বীজ বপনের পূর্বে জমিতে সেচ প্রদান, বীজ বপনের জন্য ফারো ও রীজ পদ্ধতি অবলম্বন, মালচিং, জমিতে গভীর চাষ দেওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পরিবর্তিত জলবায়ুতে টেকসই কৃষি এবং বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য লবণাক্ততাজনিত অভিঘাত প্রশমনের জন্য উপরে বর্ণিত পদ্ধতিসমূহ ব্যতীত কতিপয় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
অজৈব ও জৈব সংশোধন
লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ অজৈব সার (যেমন-জিপসাম) প্রয়োগের মাধ্যমে মাটিকে লবণাক্ততার হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ সারের ক্যালসিয়াম আয়ন বিষাক্ত সোডিয়াম আয়নকে প্রতিস্থাপিত করে মৃত্তিকা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। তবে মৃত্তিকার অজৈব সংশোধন ব্যয়বহুল এবং শ্রমসাধ্য। উপরন্তু, এটি মৃত্তিকায় অবস্থিত উপকারী জীবাণুর জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে জৈব সংশোধনের মাধ্যমে মাটির ভৌত-রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যের উন্নতি সাধিত হয়। এটি লবণের লিচিং প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং মৃত্তিকার স্থিতিশীলতা ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে  লবণাক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। অজৈব সংশোধনের তুলনায় জৈব সংশোধন সস্তা এবং সহজ। জমিতে জৈব পদার্থ প্রয়োগের ফলে মাটির পুষ্টি গুণ, জৈব পদার্থের পরিমাণ এবং মাটির ক্যাটায়ন এক্সচেঞ্জ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। জৈব পদার্থসমূহ লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে সোডিয়াম নামক বিষাক্ত আয়নের সাথে প্রতিযোগিতা করে ও উদ্ভিদের জন্য উপকারী পটাশিয়াম আয়নের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। জৈব সংশোধনের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে খামারজাত সার, পোলট্রি সার, বর্জ্য কম্পোস্ট, বায়োচার, ফ্লাই অ্যাশ, জিওলাইটস এবং মাস্টার অয়েল কেকের কম্পোস্ট উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, জৈবসার এবং জিপসাম (২৫%) এর সংমিশ্রণে ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্যভাবে ধানের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, লবণাক্ত জমিতে ৫% জিওলাইট ব্যবহার করে ক্যালসিয়াম আয়ন এর ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আয়রন ও ম্যাংগানিজ নামক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এর পরিমাণ যথাক্রমে ১৯% ও ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, জৈব সংশোধনের কার্যকারিতা অধিক বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকা থেকে নিম্ন বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকায় বেশি কার্যকরী।
অণুজীবের ব্যবহার
রাসায়নিক ও জৈবসার ব্যবহার থেকে বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের ব্যবহার অনেকগুণ ভালো বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে  অধিকাংশ অণুজীবের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব। মৃত্তিকায় অবস্থিত অণুজীবগুলোর মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদের বৃদ্ধি সহায়ক রাইজোব্যাকটেরিয়া (যেমন-সিউডোমোনাস, ক্লেবসিয়েলা, অ্যাজোটোব্যাকটর, অ্যান্টোরোব্যাকটর ইত্যাদি), ব্যাকটেরিয়া (যেমন-অ্যামোনিফিলাস, আথ্রব্যাক্টর, অ্যাজোস্পিরিলাম, ব্যাসিলাস, ব্রেভিব্যাসিলাস, ব্রেভিব্যাক্টেরিয়াম ইত্যাদি), মাইকোরাইজা এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া যা বিভিন্ন হরমোন এবং উপকারী পদার্থ তৈরির মাধ্যমে মৃত্তিকা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
ফাইটোহরমোনের ব্যবহার
ফাইটোহরমোন হচ্ছে এক ধরনের সিগনালিং মলিকিউল, যা উদ্ভিদ কোষে অল্প পরিমাণে থাকে। ফাইটোহরমোন স্বাভাবিক এবং অসহিষ্ণু (লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন অজৈব অভিঘাত) উভয় পরিবেশেই উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং বিকাশে প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অভিঘাত মোকাবিলায় অ্যাবসিসিক এসিড, সাইটোকাইনিন, জিব্রালিক এসিড, ইথিলিন, স্যালিসিলিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অক্সাইড, জ্যাসমোনেট, জ্যাসমোনিক এসিড নামক বিভিন্ন ধরনের ফাইটোহরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ- অ্যাবসিসিক এসিড লবণাক্ত পরিবেশে পত্ররন্ধের স্টোমাটা বন্ধের মাধ্যমে উদ্ভিদকে পানি ঘাটতির হাত থেকে রক্ষা করে যার ফলে বাষ্পীভবনের পরিমাণ কমে যায়। আবার অ্যাবসিসিক এসিড প্রোলিন নামক অসমোরেগুলেটরি পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে অসমোটিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে উদ্ভিদকে লবণাক্ততাজনিত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। অন্যদিকে সাইটোকাইনিন লবণাক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের কোষ বিভাজন এবং বৃদ্ধির পাশাপাশি পুষ্টি গ্রহণ ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে লবণাক্ততার নেতিবাচক প্রভাবকে প্রতিরোধ করে।
লবণাক্তসহিষ্ণু জাতের ব্যবহার
লবণাক্ত অঞ্চলে ফসলের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাতের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ফসলের লবণ সহনশীলতার মাত্রা বিভিন্ন রকম এবং এই লবণ সহনশীলতার মাত্রার ওপর ভিত্তি করে ফসলকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা হয়েছে যেমন- লবণ সহনশীল (রায়, ক্যানোলা, সুগারবিট, তুলা, বার্লি, কেনাফ, বার্মুডাঘাস), মধ্যম মাত্রার লবণ সহনশীল (বার্লি, গম, সরগম, সয়াবিন, সূর্যমুখি, কাউপি), লবণ সংবেদনশীল (ধান) ও মধ্যম মাত্রার লবণ সংবেদনশীল (আখ, ভুট্টা, তিসি, ব্রোকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সিলারি, টমেটো, শসা, লেটুস, আলফা-আলফা)। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল তথা লবণাক্ত এলাকায় চাষাবাদের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন ফসলের (যেমন- ধানের ক্ষেত্রে ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮, বিনা ধান২৩, ব্রি ধান৬১, ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯, বিনা ধান৮, বিনা ধান১০; সরিষার ক্ষেত্রে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭) লবণাক্তসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব লবণাক্তসহিষ্ণু জাতের চাষাবাদ খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করে।
হ্যালোফাইট এর ব্যবহার
হ্যালোফাইট বলতে এমন উদ্ভিদকে বোঝায় যা লবণাক্ত পরিবেশে নিজেতে মানিয়ে নিতে পারে এবং স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে পারে। পান্ডানাস, পোঙ্গামিয়া, প্যানিকাম, প্লান্টাগো, পোর্টেরাসিয়া, প্রসোপিস, রাইজোফোরা, স্যালিকর্নিয়া এবং সালভাডোরা প্রজন্মের হ্যালোফাইটগুলো লবণাক্ত মাটি পুনরুদ্ধারের জন্য খুবই জনপ্রিয়। এই সমস্ত হ্যালোফাইটগুলোর কতিপয় বৈশিষ্ট্য গ্লাইকোফাইটে (অধিকাংশ ফসল যা তুলনামূলকভাবে লবণাক্ততার প্রতি সংবেদনশীল) স্থানান্তরিত করতে পারলে লবণাক্ত সহনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং  লবণাক্ত পরিবেশে গ্লাইকোফাইট উদ্ভিদসমূহকে অভিযোজিত হতে সহায়তা করবে।
গ্রাফটিং কৌশল
সাধারণত উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের বিভিন্ন অজৈব অভিঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য গ্রাফটিং কৌশল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে লবণসহনশীল জাতের রুটস্টক এর সাথে গ্রাফটিং করা সায়নগুলো লবণ সহনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইম এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভিদকে লবণাক্ত পরিবেশে টিকে থাকতে সহায়তা করে। কৌলিতাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে গ্রাফটিং এখনও অনাবিষ্কৃত। কিন্তু এটি লবণাক্ত সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য একটি আশাপ্রদ কৌশল হতে পারে।   
সংরক্ষিত পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনা
শস্যের অবশিষ্টাংশ সংরক্ষণ, ন্যূনতম চাষ এবং শস্য বহুমুখীকরণ; এই তিনটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সংরক্ষিত পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবর্তিত জলবায়ুতে মাটির লবণাক্ততা সঠিকভাবে মোকাবিলার মাধ্যমে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
আধুনিক সেচ এবং নিষ্কাশন কৌশল
বিশ্বের শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি টেকসই কৃষির পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সেচযোগ্য এলাকার প্রায় ৪৩% ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। অতএব, টেকসই ফসল উৎপাদনে লবণাক্ত ভূগর্ভস্থ পানি মোকাবিলার জন্য কৌশলগত পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো প্রধানত ধান-গম শস্যপর্যায়ের উপর নির্ভর করে। এই শস্যপর্যায়ে অধিক পরিমাণে সেচের পানি (২০০-২৫০ সেমি/বছর), কৃত্রিম সার, ও শ্রমিক ব্যবহার হয়ে থাকে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্তিকা লবণাক্ততা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ত পানি দিয়ে সেচের ফলে মৃত্তিকা লবণাক্ততা ১২.২ ডেসি/মি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলস্বরূপ মৃত্তিকার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তাই লবণাক্ততা এড়াতে এবং শুকনো জমিতে পানির ঘাটতি পূরণের জন্য আধুনিক শস্য ব্যবস্থাপনা অনুশীলনের সাথে সাথে মানসম্পন্ন সেচের পানির পরিমিত ব্যবহার অপরিহার্য।
ন্যানোপ্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান
কৃষিখাতের উন্নয়নে ন্যানোপ্রযুক্তি একটি সম্ভাবনাময় উদ্ভাবনী পদ্ধতি। যা বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অভিঘাতের বিরুদ্ধে কার্যকর। বর্তমানে কৃষি খাতে ন্যানোপ্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিমিতি মাত্রায় ন্যানোমেটেরিয়ালস (যেমন- কার্বন ন্যানোটিউব, মাল্টিওয়ালড কার্বন ন্যানোটিউব), ধাতব ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- সিলভার ও গোল্ড), স্ফটিক পাউডার ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রন, কোবাল্ট ও কপার) ধাতব অক্সাইড ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রনঅক্সাইড, টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড, জিংকঅক্সাইড, সিলিকন ডাইঅক্সাইড, কিউপ্রিকঅক্সাইড, সেরিয়ামঅক্সাইড, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট) এর ব্যবহারের মাধ্যমে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা, বায়োমাস, অসমোলাইটস এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর বৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে পরিবেশবান্ধব, কার্যকরী ও টেকসই উৎপাদন প্রযুক্তি গ্রহণ এবং পরিবর্তিত জলবায়ুতে অভিযোজন খুবই জরুরি। উপরন্তু, লবণাক্ত এলাকায় উপরোক্ত পদ্ধতি/প্রযুক্তিসমূহের ব্যবহার এবং নিত্যনতুন গবেষণা কার্যক্রম খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
 
লেখক : উপব্যবস্থাপক (উন্নয়ন), মহাব্যবস্থাপক (বীজ) দপ্তর, বিএডিসি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৬২৭৩৩৮৭২৭ ইমেইল : ংরশফবৎৎরঢ়ড়হ@মসধরষ.পড়সজলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা ও খাদ্য নিরাপত্তা
ড. রিপন সিকদার
খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন একুশ শতকের সবচেয়ে বড় দুইটি চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা ৯ বিলিয়নে পৌঁছাবে এবং খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা ৮৫% বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে খরা, ভারী বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার তারতম্য, লবণাক্ততা এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণের কারণে কৃষি খাত হুমকির সম্মুখীন। প্রতি ডিগ্রি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বজুড়ে প্রধান খাদ্যশস্য যেমন- গম, চাল, ভুট্টা এবং সয়াবিনের উৎপাদন যথাক্রমে ৬.০% ৩.২%, ৭.৪% এবং ৩.১% হ্রাসের পূর্বাভাসও রয়েছে।
বৈষ্ণিক উষ্ণতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লবণাক্ততাজনিত সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে এই সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও লবণাক্ততা একটি প্রধান প্রাকৃতিক সমস্যা যা ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই ২০১২) এর তথ্য মতে, উপকূলীয় অঞ্চলের ২.৮৬০ মিলিয়ন হেক্টরের মধ্যে প্রায় ১.০৫৬ মিলিয়ন হেক্টর আবাদযোগ্য জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয়          কৃষি জমিতে মৃত্তিকা লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচ্য। উল্লেখ্য, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিগত ২৫ বছরে লবণাক্ততা ১ থেকে ৩৩% বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের ফলে খরা এবং বৃষ্টিপাতের মাত্রা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গড় মানের উপরে অবস্থান করছে। অগভীর পানির স্তর এবং সমুদ্রের পানির অনুপ্রবেশসহ উপকূলীয় অঞ্চলে পানির ঊর্ধ্বমুখী গতির ফলে উদ্ভিদের মূলাঞ্চলে লবণাক্ততা দেখা দেয়। মূলত বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন মৃত্তিকা লবণাক্ততার উপর বেশি প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শুষ্ক কৃষি জমিতে মৃত্তিকা লবণাক্ততা বৃদ্ধির জন্য বর্ধিত তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাত হ্রাসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব একে অপরের সাথে ধনাত্মকভাবে বা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
লবণাক্ততা একটি পরিবেশগত সমস্যা। যা কৃষি উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহত করে। বিশ্বব্যাপী ৮৩১ মিলিয়ন হেক্টরেরও বেশি কৃষি জমি লবণাক্ততা (লবণাক্ত প্রভাবিত এলাকা ৩৯৭ মি. হে ও সোডিসিটি বা ক্ষারীয় প্রভাবিত এলাকা ৪৩৪ মি. হে) দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত (সূত্র : খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ২০১৭)। লবণাক্ত পানি দিয়ে সেচ, কম বৃষ্টিপাত এবং উচ্চ বাষ্পীভবনের কারণে কৃষি জমিতে বার্ষিক ১০% হারে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হারে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০% এর বেশি আবাদি জমি লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লবণাক্ত জমিতে আবাদ সম্প্রসারণ বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১-২% জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হচ্ছে। চাষকৃত এলাকার প্রায় ৬% ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যার ফলে ধান, গম ও ভুট্টার মতো প্রধান দানাশস্যের ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চমাত্রার বাষ্পীভবনের কারণে মৃত্তিকা পৃষ্ঠের উপরের স্তরে লবণ জমা হয়। এই ধরনের লবণাক্ততার কারণে ভূগর্ভস্থ পানি লোনা হয়ে যায়। উচ্চ পরিমাণে দ্রবণীয় লবণের  সোডিয়াম ও ক্লোরিন আয়ন থাকে যা উপকারী পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং নাইট্রেট আয়নের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এই ক্ষতিকর সোডিয়াম ও ক্লোরিন আয়নের উপস্থিতি উচ্চমাত্রার আয়নিক লবণাক্ততা তৈরি করে, যা রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন সৃষ্টি করতে সহায়তা করে এবং ফসলের ফলনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
বীজের অংকুরোদগম থেকে শুরু করে চারা বড় হওয়া পর্যন্ত জমিতে লবণাক্ততা হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি/কৌশল অবলম্বন করা হয়ে থাকে যেমন- মৃত্তিকার ওপরের স্তর আঁচড়ানো, মৃত্তিকার উপরের স্তর অপসারণ, মানসম্পন্ন পানি দিয়ে বীজ বপনের পূর্বে জমিতে সেচ প্রদান, বীজ বপনের জন্য ফারো ও রীজ পদ্ধতি অবলম্বন, মালচিং, জমিতে গভীর চাষ দেওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পরিবর্তিত জলবায়ুতে টেকসই কৃষি এবং বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য লবণাক্ততাজনিত অভিঘাত প্রশমনের জন্য উপরে বর্ণিত পদ্ধতিসমূহ ব্যতীত কতিপয় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নি¤েœ আলোচনা করা হলো।
অজৈব ও জৈব সংশোধন
লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ অজৈব সার (যেমন-জিপসাম) প্রয়োগের মাধ্যমে মাটিকে লবণাক্ততার হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ সারের ক্যালসিয়াম আয়ন বিষাক্ত সোডিয়াম আয়নকে প্রতিস্থাপিত করে মৃত্তিকা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। তবে মৃত্তিকার অজৈব সংশোধন ব্যয়বহুল এবং শ্রমসাধ্য। উপরন্তু, এটি মৃত্তিকায় অবস্থিত উপকারী জীবাণুর জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে জৈব সংশোধনের মাধ্যমে মাটির ভৌত-রাসায়নিক এবং জৈবিক বৈশিষ্ট্যের উন্নতি সাধিত হয়। এটি লবণের লিচিং প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং মৃত্তিকার স্থিতিশীলতা ও পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে  লবণাক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। অজৈব সংশোধনের তুলনায় জৈব সংশোধন সস্তা এবং সহজ। জমিতে জৈব পদার্থ প্রয়োগের ফলে মাটির পুষ্টি গুণ, জৈব পদার্থের পরিমাণ এবং মাটির ক্যাটায়ন এক্সচেঞ্জ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। জৈব পদার্থসমূহ লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে সোডিয়াম নামক বিষাক্ত আয়নের সাথে প্রতিযোগিতা করে ও উদ্ভিদের জন্য উপকারী পটাশিয়াম আয়নের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। জৈব সংশোধনের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে খামারজাত সার, পোলট্রি সার, বর্জ্য কম্পোস্ট, বায়োচার, ফ্লাই অ্যাশ, জিওলাইটস এবং মাস্টার অয়েল কেকের কম্পোস্ট উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, জৈবসার এবং জিপসাম (২৫%) এর সংমিশ্রণে ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্যভাবে ধানের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, লবণাক্ত জমিতে ৫% জিওলাইট ব্যবহার করে ক্যালসিয়াম আয়ন এর ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আয়রন ও ম্যাংগানিজ নামক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এর পরিমাণ যথাক্রমে ১৯% ও ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, জৈব সংশোধনের কার্যকারিতা অধিক বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকা থেকে নিম্ন বৃষ্টিপাত হওয়া এলাকায় বেশি কার্যকরী।
অণুজীবের ব্যবহার
রাসায়নিক ও জৈবসার ব্যবহার থেকে বিভিন্ন ধরনের অণুজীবের ব্যবহার অনেকগুণ ভালো বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে  অধিকাংশ অণুজীবের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব। মৃত্তিকায় অবস্থিত অণুজীবগুলোর মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদের বৃদ্ধি সহায়ক রাইজোব্যাকটেরিয়া (যেমন-সিউডোমোনাস, ক্লেবসিয়েলা, অ্যাজোটোব্যাকটর, অ্যান্টোরোব্যাকটর ইত্যাদি), ব্যাকটেরিয়া (যেমন-অ্যামোনিফিলাস, আথ্রব্যাক্টর, অ্যাজোস্পিরিলাম, ব্যাসিলাস, ব্রেভিব্যাসিলাস, ব্রেভিব্যাক্টেরিয়াম ইত্যাদি), মাইকোরাইজা এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া যা বিভিন্ন হরমোন এবং উপকারী পদার্থ তৈরির মাধ্যমে মৃত্তিকা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
ফাইটোহরমোনের ব্যবহার
ফাইটোহরমোন হচ্ছে এক ধরনের সিগনালিং মলিকিউল, যা উদ্ভিদ কোষে অল্প পরিমাণে থাকে। ফাইটোহরমোন স্বাভাবিক এবং অসহিষ্ণু (লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন অজৈব অভিঘাত) উভয় পরিবেশেই উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং বিকাশে প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অভিঘাত মোকাবিলায় অ্যাবসিসিক এসিড, সাইটোকাইনিন, জিব্রালিক এসিড, ইথিলিন, স্যালিসিলিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অক্সাইড, জ্যাসমোনেট, জ্যাসমোনিক এসিড নামক বিভিন্ন ধরনের ফাইটোহরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ- অ্যাবসিসিক এসিড লবণাক্ত পরিবেশে পত্ররন্ধের স্টোমাটা বন্ধের মাধ্যমে উদ্ভিদকে পানি ঘাটতির হাত থেকে রক্ষা করে যার ফলে বাষ্পীভবনের পরিমাণ কমে যায়। আবার অ্যাবসিসিক এসিড প্রোলিন নামক অসমোরেগুলেটরি পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে অসমোটিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে উদ্ভিদকে লবণাক্ততাজনিত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। অন্যদিকে সাইটোকাইনিন লবণাক্ত পরিবেশে উদ্ভিদের কোষ বিভাজন এবং বৃদ্ধির পাশাপাশি পুষ্টি গ্রহণ ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে লবণাক্ততার নেতিবাচক প্রভাবকে প্রতিরোধ করে।
লবণাক্তসহিষ্ণু জাতের ব্যবহার
লবণাক্ত অঞ্চলে ফসলের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাতের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ফসলের লবণ সহনশীলতার মাত্রা বিভিন্ন রকম এবং এই লবণ সহনশীলতার মাত্রার ওপর ভিত্তি করে ফসলকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা হয়েছে যেমন- লবণ সহনশীল (রায়, ক্যানোলা, সুগারবিট, তুলা, বার্লি, কেনাফ, বার্মুডাঘাস), মধ্যম মাত্রার লবণ সহনশীল (বার্লি, গম, সরগম, সয়াবিন, সূর্যমুখি, কাউপি), লবণ সংবেদনশীল (ধান) ও মধ্যম মাত্রার লবণ সংবেদনশীল (আখ, ভুট্টা, তিসি, ব্রোকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সিলারি, টমেটো, শসা, লেটুস, আলফা-আলফা)। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল তথা লবণাক্ত এলাকায় চাষাবাদের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন ফসলের (যেমন- ধানের ক্ষেত্রে ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮, বিনা ধান২৩, ব্রি ধান৬১, ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯, বিনা ধান৮, বিনা ধান১০; সরিষার ক্ষেত্রে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭) লবণাক্তসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব লবণাক্তসহিষ্ণু জাতের চাষাবাদ খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করে।
হ্যালোফাইট এর ব্যবহার
হ্যালোফাইট বলতে এমন উদ্ভিদকে বোঝায় যা লবণাক্ত পরিবেশে নিজেতে মানিয়ে নিতে পারে এবং স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে পারে। পান্ডানাস, পোঙ্গামিয়া, প্যানিকাম, প্লান্টাগো, পোর্টেরাসিয়া, প্রসোপিস, রাইজোফোরা, স্যালিকর্নিয়া এবং সালভাডোরা প্রজন্মের হ্যালোফাইটগুলো লবণাক্ত মাটি পুনরুদ্ধারের জন্য খুবই জনপ্রিয়। এই সমস্ত হ্যালোফাইটগুলোর কতিপয় বৈশিষ্ট্য গ্লাইকোফাইটে (অধিকাংশ ফসল যা তুলনামূলকভাবে লবণাক্ততার প্রতি সংবেদনশীল) স্থানান্তরিত করতে পারলে লবণাক্ত সহনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং  লবণাক্ত পরিবেশে গ্লাইকোফাইট উদ্ভিদসমূহকে অভিযোজিত হতে সহায়তা করবে।
গ্রাফটিং কৌশল
সাধারণত উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের বিভিন্ন অজৈব অভিঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য গ্রাফটিং কৌশল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে লবণসহনশীল জাতের রুটস্টক এর সাথে গ্রাফটিং করা সায়নগুলো লবণ সহনশীলতার মাত্রা বৃদ্ধি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইম এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভিদকে লবণাক্ত পরিবেশে টিকে থাকতে সহায়তা করে। কৌলিতাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে গ্রাফটিং এখনও অনাবিষ্কৃত। কিন্তু এটি লবণাক্ত সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য একটি আশাপ্রদ কৌশল হতে পারে।   
সংরক্ষিত পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনা
শস্যের অবশিষ্টাংশ সংরক্ষণ, ন্যূনতম চাষ এবং শস্য বহুমুখীকরণ; এই তিনটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সংরক্ষিত পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবর্তিত জলবায়ুতে মাটির লবণাক্ততা সঠিকভাবে মোকাবিলার মাধ্যমে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
আধুনিক সেচ এবং নিষ্কাশন কৌশল
বিশ্বের শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি টেকসই কৃষির পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সেচযোগ্য এলাকার প্রায় ৪৩% ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। অতএব, টেকসই ফসল উৎপাদনে লবণাক্ত ভূগর্ভস্থ পানি মোকাবিলার জন্য কৌশলগত পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো প্রধানত ধান-গম শস্যপর্যায়ের উপর নির্ভর করে। এই শস্যপর্যায়ে অধিক পরিমাণে সেচের পানি (২০০-২৫০ সেমি/বছর), কৃত্রিম সার, ও শ্রমিক ব্যবহার হয়ে থাকে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্তিকা লবণাক্ততা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ত পানি দিয়ে সেচের ফলে মৃত্তিকা লবণাক্ততা ১২.২ ডেসি/মি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলস্বরূপ মৃত্তিকার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তাই লবণাক্ততা এড়াতে এবং শুকনো জমিতে পানির ঘাটতি পূরণের জন্য আধুনিক শস্য ব্যবস্থাপনা অনুশীলনের সাথে সাথে মানসম্পন্ন সেচের পানির পরিমিত ব্যবহার অপরিহার্য।
ন্যানোপ্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান
কৃষিখাতের উন্নয়নে ন্যানোপ্রযুক্তি একটি সম্ভাবনাময় উদ্ভাবনী পদ্ধতি। যা বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অভিঘাতের বিরুদ্ধে কার্যকর। বর্তমানে কৃষি খাতে ন্যানোপ্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিমিতি মাত্রায় ন্যানোমেটেরিয়ালস (যেমন- কার্বন ন্যানোটিউব, মাল্টিওয়ালড কার্বন ন্যানোটিউব), ধাতব ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- সিলভার ও গোল্ড), স্ফটিক পাউডার ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রন, কোবাল্ট ও কপার) ধাতব অক্সাইড ন্যানোপার্টিকেলস (যেমন- আয়রনঅক্সাইড, টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড, জিংকঅক্সাইড, সিলিকন ডাইঅক্সাইড, কিউপ্রিকঅক্সাইড, সেরিয়ামঅক্সাইড, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট) এর ব্যবহারের মাধ্যমে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা, বায়োমাস, অসমোলাইটস এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর বৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে পরিবেশবান্ধব, কার্যকরী ও টেকসই উৎপাদন প্রযুক্তি গ্রহণ এবং পরিবর্তিত জলবায়ুতে অভিযোজন খুবই জরুরি। উপরন্তু, লবণাক্ত এলাকায় উপরোক্ত পদ্ধতি/প্রযুক্তিসমূহের ব্যবহার এবং নিত্যনতুন গবেষণা কার্যক্রম খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
 
লেখক : উপব্যবস্থাপক (উন্নয়ন), মহাব্যবস্থাপক (বীজ) দপ্তর, বিএডিসি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৬২৭৩৩৮৭২৭ ইমেইল : ংরশফবৎৎরঢ়ড়হ@মসধরষ.পড়স


COVID19 Movement Pass Online Police Clearance BD Police Help line Expatriate Cell Opinion or Complaint NIS Bangladesh Police Hot Line Number Right to Information PIMS Police Cyber Support for Women BPWN Annual Training Workshop Achievement & Success PHQ Invitation Card
Press Release Recruitment Information Procurement / Tender Notice Legal Instrument Innovation Corner Detective Magazine Bangladesh Football Club Diabetes-Covid19 Exam Results Accident Info Important Forms

Apps

icon icon icon icon icon icon